ভারতীয় সংবিধান হচ্ছে পৃথিবীর সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে বৃহত্তম লিখিত সংবিধান যা ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে এই কার্যকরী হয়। ভারতীয় সংবিধানে মোট ২৪টি অংশে ৪৪৮টি ধারা, ১২টি তফসিল এবং ১১৩টি সংশোধনী বিদ্যমান। ভারতের সংবিধানের ইংরেজি সংস্করণে মোট শব্দসংখ্যা ১১৭,৩৬৯।
১৯৭৬ সালে ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি দ্বারা স্বাক্ষরিত ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে 'সমাজতান্ত্রিক' এবং 'ধর্মনিরপেক্ষ' (কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই) শব্দদুটি যুক্ত করা হয়। এরপরে সংবিধানের মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করার পরে যেখানে লেখা হয়েছে -
"We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;"(অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি)।
ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) বা ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism) শব্দটির উৎপত্তি ইউরোপে যার অভিধানিক অর্থ হচ্ছে- "An ism does not related with religion and non-entity to any supernatural existence"। অর্থাৎ, ধর্ম এবং অলৌকিকতার সঙ্গে কোনরূপ সম্পর্কিত নয় এমন একটি মতবাদ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। অন্যদিকে, নিরপেক্ষ শব্দটির অর্থ, কোনো অথবা কারোর পক্ষেই অবস্থান নয়। ধর্মনিরপেক্ষ মানে সর্বধর্মসমন্বয়ও নয়। এর অর্থ রাষ্ট্র কোনো ধর্মের পক্ষেই থাকবেনা বরং সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই থাকবে নিরপেক্ষ বা সম্পর্ক বর্জিত। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাষ্ট্র কোনো ধর্মকেই পক্ষপাত করে না। এই মতবাদ অনুযায়ী, সরকার বা রাষ্ট্র কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোন ধর্মকে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদানও করবে না। জনগণকে ধর্ম পালনে বাধ্য করাও হবে না। সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে।
এইপ্রসঙ্গে উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে- "The separation of religion and state is the foundation of secularism. It ensures religious groups don't interfere in affairs of state, and the state doesn't interfere in religious affairs."
ভারতীয় সংবিধান আমজনতাকে দিয়েছে ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights of Indian Constitution) যার মধ্যে একটি ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার যা সংবিধানের ২৫-২৮ নং ধারায় উল্লেখিত রয়েছে। সেগুলো যথাক্রমে-
(১) ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা:
সংবিধানের ২৫(১) নং ধারায় লেখা হয়েছে, বিবেকের স্বাধীনতা এবং ধর্মস্বীকার, ধর্মপালন ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা সব নাগরিকের রয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্য, জনশৃঙ্খলা বা সামাজিক নীতিবােধ এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র এই অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ছাড়া কোনাে বিশেষ আচার-অনুষ্ঠান কোনাে ধর্মের অঙ্গ কি না তা বিচার করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে বলে সুপ্রিমকোর্ট ১৯৮৮ সালে হানিফ কুরেশি বনাম বিহার রাজ্য মামলায় রায় দেন।
২৫(২) (ক) নং ধারায় লেখা হয়েছে, ধর্মাচরণের সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বা অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাষ্ট্রের রয়েছে। তা ছাড়া সামাজিক কল্যাণসাধন ও সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র প্রয়ােজনমতাে আইন প্রণয়ন করে ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
২৫(২) (খ) নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে, হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে সব হিন্দুধর্মাবলম্বী ব্যক্তির জন্য উন্মুক্ত রাখতে রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করতে পারবে। সংবিধানে হিন্দু শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে শিখ, জৈন এবং বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
(২) ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির স্বাধীনতা:
সংবিধানের ২৬ নং ধারা অনুযায়ী প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গােষ্ঠীকে কয়েকটি অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেগুলি হল-
(ক) ধর্ম বা দানের উদ্দেশ্যে সংস্থা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ,
(খ) নিজেদের ধর্মীয় কার্যকলাপ নিজেরাই পরিচালনা করা,
(গ) স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জন ও ভােগদখল করা এবং
(ঘ) আইন অনুযায়ী নিজস্ব সম্পত্তি পরিচালনা করা।
তবে রাষ্ট্র জনস্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা রক্ষার জন্য যে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ধর্মীয় গােষ্ঠীর এই অধিকারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
(৩) কর আদায় সংক্রান্ত বিধিনিষেধ:
সংবিধানের ২৭ নং ধারায় লেখা হয়েছে, ধর্ম বা ধর্মসম্প্রদায়ের প্রসার বা রক্ষপাবেক্ষণের জন্য কোনাে ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে কর দিতে বাধ্য করা যাবে না।
(৪) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষার বিধিনিষেধ:
সংবিধানের ২৮ নং ধারায় বলা হয়েছে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরােপুরি সরকারি সাহায্যে পরিচালিত হয় সেখানে ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বা আংশিকভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার্থীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের বিনা অনুমতিতে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যাবে না। সম্পূর্ণ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবশ্য ধর্মশিক্ষা নিষেধ করা হয়নি। বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত হলেও কোনাে দাতা বা অছির উইলে ধর্ম বিষয়ে শিক্ষাদানের কথা উল্লিখিত থাকলে, সেখানে ধর্মশিক্ষা দেওয়া যাবে।
প্রসঙ্গত জানাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মশিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। যেমন- সংবিধানের ২৮(১) ধারায় লেখা হয়েছে যে, 'No religious instruction shall be provided in any educational institution wholly maintained out of State funds.'অর্থাৎ, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনোরকম ধর্মীয় নির্দেশ, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা যাবেনা। আবার, ২৮(২) নং ধারায় লেখা হয়েছে- 'Nothing in clause 28(1) shall apply to an educational institution which is administered by the State but has been established under any endowment or trust which requires that religious instruction shall be imparted in such institution.' ফলে কনভেন্ট স্কুল বা মিশনারি স্কুল কিংবা বৈদিক বিদ্যালয় অথবা মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না। এই স্ববিরোধীতা সংশোধনের বিশেষ প্রয়োজন বলে মনে করেন যুক্তিমনষ্ক মানুষেরা।
ঋণ স্বীকার: আমাদের সংবিধান, সুভাষ সি কাশ্যপ, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট